রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

প্রতি দু’মিনিট অন্তর হাসপাতালে আসছে ডেঙ্গু রোগী 

স্টাফ রিপোর্টার: ডেঙ্গু নিয়ে প্রতি দুই মিনিট অন্তর কোনো না কোনো হাসপাতালে একজন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকার হাসাপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই অবস্থা। কয়েকদিন আগে থেকেই হাসপাতালগুলোর বেড পরিপূর্ণ। কিন্তু কি আর করা ফ্লোরেই ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা দিতে হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী আসছে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নির্ধারিত ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসছেন দলে দলে। এভাবে রোগী বাড়লে সামনে পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও ওয়ার্ড বাড়াতে হবে।

জুলাই মাসের ৭ দিনে ১৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ৫২৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬৩৭ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ১১ হাজার ২৯৮ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯ হাজার ৬৮ জন।

অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাই মাসে শনাক্ত ৩ হাজার ৩২০ জন এবং মারা গেছেন ১৮ জন।

গত জানুয়ারি থেকে জুলাই এর ৬ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৭৩ জন রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। ১লা জুলাই থেকে ৬ই জুলাই পর্যন্ত ১৯৬ জন রোগী ভর্তি হন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালটিতে।

ঢামেক হাসপাতালে ঠাঁই নেই অবস্থা। নতুন ভবনের ষষ্ট তলায় পুরুষ ও অষ্টম তলায় নারী রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। পুরনো ভবনে শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, রোগী যারা আসছে তাদের সবাইকে ভর্তি করা হচ্ছে। নতুন করে আর কলেবর বাড়ানো হবে না। কারণ কলেবর বাড়ানো হলে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার আক্রান্তদের বেশির ভাগই শক সিনড্রোমে সিভিয়ার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেমনটি ২০১৮ সালেও হয়েছিল। এ ছাড়া এবার নতুন করে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলিতে জমে থাকা পানি এবং ঈদুল আযহার দীর্ঘ ছুটিতে নাগরিকদের বাসাবাড়িতে অনুপস্থিতি।

এ মুহূর্তে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কতোটা ভয়ের, ডেঙ্গুতে এবার বেশি মৃত্যুর কারণ কী এসব বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, এ বছরের শুরুতে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও গত মাস থেকে হঠাৎ করে তা বেড়েছে। এখন যে হারে এটি বাড়ছে এবং ছড়াচ্ছে, এটি আমাদের জন্য অবশ্যই ভয়ের কারণ। এবার যারা আসছে তাদের অধিকাংশই দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত। ক্লাসিক ডেঙ্গুর যে উপসর্গগুলো আমরা জানতাম, দ্বিতীয় দফায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যতিক্রম হচ্ছে। জ্বর ও মাথাব্যথার সঙ্গে পেট ও বুকের ব্যথা দেখা যাচ্ছে। ব্যথার পরিমাণ এত বেশি যে মনে হচ্ছে শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাচ্ছে। ডেঙ্গু এখন সব জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে। এখন আর নির্দিষ্ট কোনো এলাকা থেকে রোগী আসছে না। সারা ঢাকা শহর থেকেই রোগী আসছে। 

এমনকি ঢাকার বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী ভর্তি হচ্ছে। দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে এবং যথাসময়ে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা শুরু করলে খুব বেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু যদি রোগী যথাসময়ে না আসেন, তাহলে তাকে রিকভার করা খুব কঠিন হয়ে যায়। এমনকি তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। মৃত্যুর বড় কারণ হলো লেট রেফারেল। পরিচালক বলেন, উপসর্গগুলোর সঙ্গে রোগীরা খুব বেশি পরিচিত নয়। যেমন-একজন রোগীর শুরুতে জ্বর ছিল, এরপর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলো। কিন্তু রোগী জানতেই পারলো না যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় তার শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে। যা ডেঙ্গুর বড় একটি উপসর্গ। উপসর্গের মধ্যে অন্যতম হলো বমি। কারও দীর্ঘস্থায়ী বমি হলে, এমনকি সেটা ওষুধ খেয়েও না কমলে দ্রুত হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। 

কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। গত পাঁচ বছরে ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এ বছরের জুন পর্যন্ত মোট রোগী গত পাঁচ বছরের হিসাব টপকে বেশ বিপজ্জনক মাত্রায় অবস্থান করছে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকার রোগী প্রায় ৮৮ শতাংশ এবং ঢাকার বাইরের ১২ শতাংশ। আমাদের গবেষণাগারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও এডিস মশার ঘনত্বের তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটারে মাল্টিভেরিয়েন্ট অ্যানালাইসিস করে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করে ডেঙ্গু পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এর আগে আমরা যেসব পূর্বাভাস দিয়েছি তার প্রতিটি মিলে গেছে। 

এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) ডেন-২-এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩-এ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এ তথ্য জানিয়েছে। রোগতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। ডেঙ্গুর একটি ধরনে আক্রান্ত হলে সেই নির্দিষ্ট ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে গড়ে ওঠে, পরবর্তী সময়ে সেই ধরনটিতে মানুষ আর আক্রান্ত হয় না। তবে অন্য ধরনে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে মোট চারবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা দুটিই বাড়ে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ